ধারাবাহিক উপন্যাসঃ নাইয়র (পর্ব-এক)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৮:৫৪:৫৭ সকাল
এই উপন্যাসটিতে আমাদের টিপিক্যাল সমাজের একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে- গ্রামীন পটভূমিতে। গ্রামকে ঘিরেই তো আমাদের এই দেশ। এক একটি গ্রাম যদি সব দিক দিয়ে ঠিক হয়ে যায়, তবে পুরো দেশটি বদলে যেতে বাধ্য। এই গ্রামটিতে বিরাজমান অশিক্ষা, কুসংস্কার, সামন্তবাদি মনোভাবের একচেটিয়াত্ব, ধর্মের যথেচ্ছা ভুল ব্যবহার, নষ্ট রাজনীতির প্রভাব- সর্বোপরি বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আমার সীমিত অনুভূতির দ্বারা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। নাইয়র বলতে আমরা সাধারণত কোনো মেয়ের তার মায়ের কাছে ফিরে আসা বুঝে থাকি। এখানে এটি রুপক অর্থে বুঝাতে চেয়েছি। আমাদের চিন্তা আর অনুভূতিতে যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে, সে থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের প্রিয় স্বদেশ-আমাদের মাতৃভূমির কোলে নিজে সম্পুর্ণরুপে ফিরে আসাই হল এই কাহিনীর 'নাইয়র'। এ কেবলি কোনো মেয়ের নয়, আপনার, আমার, আমাদের সকলের সত্য-সুন্দরের জন্য দেশ মাতৃকার কাছে ফিরে আসা। মোট পনেরটি পর্বে লেখাটি শেষ করবার ইচ্ছে রয়েছে। আজ ১ম পর্বটি দেয়া হল।
নাইয়র
[এখানে উল্লেখ করা প্রতিটি চরিত্রই কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে এর কোনো মিল নেই। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু স্থানের নাম নিতে হয়েছে। তবে সেগুলো শুধুই গল্পের প্রয়োজনে। সমস্ত ঘটনাই লেখকের কল্পনাপ্রসুত। তাই কেউ কোনো স্থান-কাল-পাত্রভেদে যে কোনো ধরণের মিল খুঁজে পেলে, তা নিছকই কাকতালীয় বলে ধরে নিতে হবে।]
এক.
কালিগঙ্গা নদী যেখান থেকে বাঁক নিয়ে ডানে চলে গেছে, এর পরের দুটি বাঁকের পরই পারুলের গ্রাম। বেশ বড় একটি বাজার। লঞ্চ ঘাটটিও বাজারের একেবারে শেষ মাথায়। ঢাকা থেকে বড় লঞ্চ পারুলকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছে, সেখান থেকে এই বাজার পর্যন্ত টেডি লঞ্চ (এক তলা ছোট লঞ্চ) চলাচল করে। কিন্তু তারও নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। ভোর রাতে সে টার্মিনালে নেমেছে। আর টেডি লঞ্চ ছাড়বে সেই দুপুরে। এতোক্ষণ অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না।
এখন অবশ্য পারুলের জীবনে কোনো কাজেরই কোনো মানে নেই। এটা ঠিক এই মুহুর্তে ওর ধারণা। একটু পাগলাটে ধরণের মেয়ে হিসাবে ওর সুখ্যাতি রয়েছে। তাই বলে অন্য আর দশটা মেয়ের মতো অবলা বোবা প্রানী ভাবলেই ভুল করতে হবে। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা না করলে দু'ভাবে সে বাড়ি যেতে পারে। এক হল, পিরোজপুর শহরে গিয়ে সেখান থেকে বাসে করে নাজিরপুর, তারপর ভ্যান বা রিক্সায় করে শ্রীরামকাঠী বাজার। এরপর পায়ে হেঁটে বাড়িতে। তাও হাঁটতে হবে প্রায় আধা ঘন্টার মত।
কোনো কিছু চিন্তা না করেই একটা নৌকা ভাড়া করল পারুল। সাথে জিনিসপত্র বলতে একটা মোটামুটি ধরণের সুটকেস। আর চেইনওয়ালা একটা ছোট ব্যাগ... পলিথিনে রয়েছে পাউরুটি যার অর্ধেকটা সে লঞ্চে খেয়েছে। চারটি মর্তমান কলাও ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। আর নিজের শরীরের চামড়ার নীচে ভাঙাচোরা একটা হৃদয়। ব্যস ! লাগেজ বলতে শুধু এইগুলোই। তবে ওর কাছে ভাঙাচোরা হৃদয়ের ওজনই বেশী হবে বলে মনে হল।
একা মেয়েমানুষ এতোদূর নৌকায় যাবে। কয়েকজন আগ্রহী হল ওকে নিয়ে যাবার জন্য। সাধারণত আজকাল এতো দূরে সেই আগের মতো ছইওয়ালা নৌকা ভাড়া করে কেউ যায় না। পারুলের ছেলেবেলায় বাবা মায়ের সাথে সে অনেক এভাবে গিয়েছে। বিশেষ করে মায়ের সাথে তাঁর নাইয়র যাবার সময়গুলো কতটা আনন্দে কেটেছে।একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো... প্রায় শেষ মুহূর্তে সেটাকে গোপন করে তিনজন মাঝির ভিতরে অপেক্ষাকৃত যুবক জনকেই বেছে নিলো সে। সবাই এ ক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষকে ই বেছে নিতো। কিন্তু বাকি দুজনের চোখের নজর সে এই অল্প সময়েই পরখ করে দেখেছে। এই যুবক লোকটিকেই ওর মেয়েলি ইন্সটিংক্টে অধিকতর নিরাপদ মনে হয়েছে।
নিরাপদ!
হাসি গোপন করতে চাইলেও সম্পুর্ণ গোপন করা গেলো না। মাঝি তিনজন ওকে হঠাৎ এভাবে হাসতে দেখে একে অন্যের দিকে তাকালো। তাতে 'মেয়েটি পাগল নাকি' টাইপ নীরব ভাষা জড়িয়ে আছে। পারুলও ব্যাপারটা খেয়াল করল। কিন্তু কোনো কথা না বলে নিজের লাগেজের দিকে হাত বাড়াতেই ওর ভাড়া করা মাঝি ওকে থামালো। বলল,' আপনে নৌকায় ওঠেন। আমি ওগুলান উঠাইতেছি।' কিছু না বলে পারুল ওর পার্স হাতে নৌকায় উঠে যায়। মালামাল নিয়ে মাঝিও উঠে। দড়ি খুলে একটা বাঁশের লগি নিয়ে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে নৌকাকে টার্মিনাল থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। স্রোতের অনুকুলেই যাবে ওরা। নির্দিষ্ট স্রোতে গিয়ে নৌকা পড়তেই মাঝি বৈঠা হাতে নেয়। ভিতরে বসে পারুল সব দেখে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। নদীর মাঝে বয়ে যাওয়া বাতাস খুব আরামপ্রদ। তবে একটানা শরীরে লাগলে ঠান্ডা লেগে যায়।
এই লোকটাকে সে ভাড়া করেছে।
লোকটাকে না লোকটার নৌকাকে? নাকি দুজনকেই?
ভাবনাটা কেমন যেন একটা মাতাল করা অনুভুতি জাগায়। ঠিক এই একই চিন্তা যদি মাঝির দিক থেকে হতো? চিন্তার জগতে সেটাকে কি শোভনীয় বলা যেতো? কেন এমন হয়? একজন পুরুষ একজন মেয়েকে ভাড়া করেছে- শুনতেই খারাপ বোধটা প্রথমে কেন জাগে মনে? সে নিজে যদি একজন পুরুষ হতো, আর মাঝির যায়গায় যদি কোনো মহিলা হতো? তখন কি এই খারাপ বোধটুকু আসত? আজকাল ট্রেনচালক, বৈমানিক থেকে শুরু করে আরো অনেক গুরুত্তপুর্ণ পদে মেয়েরা রয়েছে।
লোকটা একমনে নৌকা বেয়ে চলেছে। কত বয়স হবে। ২৮ কি ৩০ বছর। পারুল তাঁকে জিজ্ঞেস করে,'তোমার নাম কি ভাই?' ভাই বলাতে মাঝি লোকটা একটু চমকে গেলো কি? নাহ! মানুষকে পরখ করতে করতে সে একটু বেশীই দেখছে বোধ হয় আজকাল। মাঝি তাঁর নাম জানালো, ' মোসলেম খাঁ'। পারুলের কাছে খাঁ শব্দটি হাসির উদ্রেক করলেও নিজেকে গম্ভীর রাখতে পারল সে। আরো গম্ভীর হয়ে বলল, ' শোন ভাই মোসলেম খাঁ, আমি একটু ঘুমাতে চাই। তোমার নৌকায় পর্দার ব্যবস্থা নাই। আর থাকলেও আমি দিতাম না, আমার কেমন কবর কবর লাগে। আমি ঘুমালে আবার আমার কাপড় চোপর ঠিক থাকে না। তুমি আবার তাকাইয়া থাকবা না।'
মাঝি ছেলেটা লজ্জা পেলো পারুলের কথায়। কিছু না বলে একমনে বৈঠা বেয়ে চলল। পারুল ডান কাতে হাতের নীচে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করল। কতবার এভাবে নাইয়র এসেছে... এই একই পথে। কিন্তু এবারই ওর শেষ নাইয়র আসা। আর কখনো যে ফিরে যেতে হবে না ওকে। ওর পেছনের পথটি একেবারে বন্ধ করে দিয়েই সে এসেছে।
দু'ফোটা চোখের পানি গড়িয়ে হাতের উপর পড়তেই ওর ভিতরের রুদ্ধ এক শ্রাবণ মেঘ তাঁর প্রচন্ড ঘনঘটা নিয়েই ধরার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
... ... ...
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না।
পানির ছলাৎ ছলাৎ আর বৈঠার সাথে নৌকার কাঠের ঘর্ষণ মিলে অদ্ভুদ এক শব্দ হচ্ছে।একটা চিল অনেক নীচুতে শব্দ করে নৌকার উপর দিয়ে উড়ে গেলো। উঠে বসেছে পারুল। ঘুম থেকে উঠে মানুষ এক ধরণের ঘোরের ভিতরে থেকে যায়। সেটা কাটাতে কিছু সময় পার হয়। পারুলের গভীর ঘুম থেকে উঠলেই কেন যেন মরে যেতে ইচ্ছে করে। ছই এর ফাঁকা দিয়ে ওদের বাজার দেখা যাচ্ছে। এখনো অনেকটা দূরে। সবসময় ঠিক এতটা দূর থেকে চির পরিচিত সেই বাজার...নদীর বুক থেকে জন্ম নেয়া খাল... আর এদের দুয়ের সঙ্গমস্থল এর পানির ঘুর্ণি... এসবকিছু পারুলকে কেন জানি উত্তেজিত করে এসেছে। আজ মন খারাপের এই উৎসবমুখর দিনেও মোহনার কাছাকাছি এসে নিজের ভিতর সেই একই আবেগ অনুভব করে পারুল একটু অবাক হল। তবে কি কিছু কিছু আবেগের কখনোই মৃত্যু হয় না?
হয়তবা।
আবার নাও হতে পারে। সে তো আর অনুভুতি বিশেষজ্ঞ নয়। মাঝি মোসলেম খাঁ ওকে একবার দেখে পানির দিকে নজর দিলো। এই মুহুর্তে তাঁকে খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে। এখানে দুইটা স্রোত... একটা ঘুর্ণিকে পাশ কাটিয়ে যার যার গন্তব্যে বহমান। খুব পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে মোসলেম খাঁ সুন্দরভাবে নৌকাকে খালের দিকের স্রোতে নিয়ে গেলো। এই সেই শ্রীরামকাঠী খাল! নিজের বাড়ির গন্ধ মাখা আজন্ম শৈশব-কৈশোর আর যৌবনের সময়গুলো কাটিয়েছে সে এর তীরে... ছবির মত সুন্দর একটি গ্রামে!
বাজারের পশ্চিমপাশ দিয়ে খালটি বয়ে গিয়ে পুরনো মধুমতি নদীতে গিয়ে মিশেছে। ভীমকাঠী হাই স্কুলের পাশে নৌকা আসতেই পারুল মাঝিকে নৌকা পারে ভেড়াতে বলে। নৌকা একটা কালো রং করা সেতুর পিলারের গায়ে গিয়ে থামে। এই পাশে দু'একটা হিন্দু বাড়ি। তাঁরা ব্যবসার খাতিরে তাঁদের মুল বাড়ি থেকে এই বাজারে নতুন ঘর করেছে। একটা লম্বা শান বাঁধানো সিঁড়ি দেখতে পেল পারুল। পানির অনেকটা গভীরে গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে। এটা নতুন দেখল। আগে কখনো এই সিড়িটি দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না সে।একজন মধ্যবয়স্ক হিন্দুনারী খালের পানিতে গোসল করছে। কেন জানি দৃশ্যটা খুব ভালো লাগল পারুলের।
নৌকা থেকে নেমে পারুল একা বাজারের মিষ্টির দোকানের দিকে আগালো। মন্ডল মিষ্টান্ন ভান্ডার। এর মালিক পরাণ মন্ডল গত হয়েছেন অনেক আগে। এখন তাঁর ছেলে এটা চালায়। সন্তোষ মন্ডল, পারুলের সন্তোষ কাকু। দোকানে বসা ছিলেন। পারুলকে দেখে চোখে স্নেহের ভাব ফুটে উঠে। একটু খুশীও হন। এই খুশী কেন? ওর বয়সী সন্তোষ কাকুর মেয়ে যে পারুলের সই ছিল! এখন বিয়ের পরে জামাইকে নিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে। হাসির সাথে জিজ্ঞেস করলেন, 'কেমন আছিস মা? কখন এলি ? জামাইবাবাজি কই?' পারুলও হাসতে হাসতে উত্তর দেয়, ' একটু শ্বাস নিয়ে নাও কাকু। একবারে কয়টার উত্তর দেবো?' হাসির ভিতরে মনের মলিনতা বের হল কি...জামাই এর কথা বলাতে একটা নপুংশক জানোয়ারের চেহারাটা ভেসে উঠে একমুহুর্ত... নিজেকে পিছন থেকে বর্তমান দৃশ্যপটে নিয়ে আসে পারুল। মিষ্টির ভিতরে চিনির দানা, এখানে সবাই বলে 'দানাদার'। এইটি বাবার অনেক পছন্দ। এর সাথে ছোট ভাই ও বোনের পছন্দের গুলোও মিলিয়ে কয়েক কেজি কিনলো। দাম দেবার বেলায় সন্তোষ কাকু জিভ কামড়ে অনীহা প্রকাশ করেন। দুজনের ভিতর অনেকক্ষণ তর্ক চলে। শেষে মিষ্টি না নেবার হুমকিতেই হার মা্নতে হয় সন্তোষকাকুকে।
মায়ের জন্য পান কিনতে তামাক পট্টিতে যেতে হল। চলার পথে আরো কয়েকজনের সাথে দেখা। কুশল বিনিময়ের বাইরে তেমন কোনো কথা বলা হল না। আসলে চলার পথে আমরা শুধু সৌজন্য বজায় রাখতে 'কি খবর?' 'কেমন আছেন' জাতীয় কথা বার্তা বলে থাকি। ওদুদ কাকু এখনো শক্ত সামর্থ রয়েছেন। ওকে দেখে হাসলেন এবং যথারীতি সেই একই প্রশ্ন, 'জামাই বাবাজী আসে নাই?' একটা প্রচন্ড ক্রোধ পারুলের ভিতর থেকে বের হয়ে চার দিককে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে চাইলো! তবুও তাঁকে মুখে হাসি বজায় রেখে প্রসঙ্গ পালটে কিছু কথা বলতেই হয়। এরা যে ওর বড়ই আপন! সেই শিশু বেলা থেকে ওনাদের কোলে পিঠে বড় হয়েছে সে। আজ কীভাবে তাঁদের সেই আদরকে উপেক্ষা করে?
মোসলেম খাঁ নৌকায় ঊঠার সময় পারুলের হাত থেকে প্যাকেটগুলো রাখতে সাহায্য করে। পারুলের বুকের ভিতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে... এতোটুকু পথ হাঁটতেই কেন যেন হাফিয়ে উঠেছে। মনটাও তেতো হয়ে আছে। এই সমাজে একজন নারী হয়ে জন্ম নেয়াটা কি অভিশাপ? তাঁকে কেন সব সময়ই একজন পুরুষের ছায়ায় থাকতে হয়?
অনেকক্ষণ ঝিম মেরে থাকে পারুল। নৌকা কবিরাজ বাড়ি পার হয়ে মৃধাদের ঘাটলার পাশ দিয়ে যাচ্ছে। মাটির রাস্তা দিয়ে কয়েকটি উৎসুক মুখ নৌকার ভিতরের আরোহিনীকে দেখার চেষ্টা করে। সেদিকে পারুলের কোনো খেয়াল নেই। সে চিন্তার ভিতরে এক বিবশ অসহায়ত্তের মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে। আসলে গ্রামের এই সোজা মানুষ গুলোর কোনো দোষ নেই। তাঁরা আবহমানকাল ধরে এটাই দেখে আসছে। একজন নারী ধাপে ধাপে একজন পুরুষের অবলম্বনে বেঁচে থাকে। অবশ্য প্রকৃতি এবং আমাদের পুরুষ প্রধান সমাজই এই সিস্টেমের জন্য দায়ী।
রাস্তা থেকে একটা পরিচিত গলার চীৎকারে পারুলের ধ্যান ভাঙ্গে।ওর ছোট ভাই মাহমুদ বাজার থেকে ফেরার সময় কীভাবে ওকে নৌকায় দেখে ফেলে। ' আপায়! আপায় আইছে' বলে চীৎকার করে বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে। বাড়ী এখান থেকে কম করে হলেও আরো কুড়ি মিনিটের পথ। একবার মাহমুদকে ডাকে ওর সাথে নৌকায় আসার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা! পাগলা ঘোড়ার পিঠে জিন চাপিয়ে সে শিকদার বাড়ির দিকে ছুটছে। পারুলের আসার খবর একেবারে সবাইকে জানিয়ে ওদের বাড়ির ঘাটে অপেক্ষা করবে।
প্রতিবার নাইয়র আসার সময় ওর মানুষটি সাথে থাকত। মানুষ না বলে অমানুষ বললেও কম বলা হবে। তাই এবারে ওকে একা দেখেই সবার চোখে লাগছে। পারুল বাজী ধরে এ কথা বলতে পারে, সন্ধ্যার ভিতরে পুরো গ্রাম জেনে যাবে যে, রশীদ শিকদারের মেয়ের সাথে তাঁর স্বামীর ছাড়াছাড়ি (ডিভোর্স) হয়ে গেছে। এবং এর পর থেকেই সহানুভুতির উছিলায় অনেকের আগমন হবে যাদের ভিতরে বেশীর ভাগই থাকবে অহেতুক কৌতূহল নিবৃত্ত করার দলে। কিছু থাকবে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবার জন্য। তৃতীয় একটি দলও থাকবে। সব থেকে ভয়ংকর হল এই শেষের দলটি। এরা সহানুভুতির আড়ালে- ওর নিশ্চিত ভবিষ্যতের দোহাই দিয়ে ওর একহারা লোভনীয় দেহকে ভোগ করার কুৎসিত বাসনা পোষন করবে।
মন্ডল বাড়ী...তালুকদার বাড়ী...ব্যাপারি বাড়ী ধীরে ধীরে পার হয়ে যায়। খালের পানিতে মানুষের গু ভেসে যাচ্ছে। সেদিকে চোখ পড়তেই পারুল আলগোছে নজর সরিয়ে নেয়। ভাবে- ওর নিজের জীবনও কি এই গু এর মত অনিশ্চিত হয়ে গেলো না? সে ও এখানে সেখানে ধাক্কা খেতে খেতে একসময় মিলিয়ে যাবে...
কলঘরটি পার হয়ে ওদের শিকদার বাড়ির ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছাল। একটি কৃষ্ণচুড়া গাছ তাঁর বিশালতা নিয়ে খাল এবং রাস্তার বেশ অনেকটা যায়গায় ছায়া দিচ্ছে। ফুলগুলো লাল আগুন হয়ে চোখের দৃষ্টিকে কেড়ে নেয়। এই গাছের নীচে একটি কাঠের ক্লাব ঘর! এখন আর সেটি ক্লাব ঘর নেই। অনেক আগে কখনো ছিল।
এখানে একজন কবি বাস করে। এখনো করে কিনা জানে না। গতবার নাইয়র এসেও তাঁকে পেয়েছিল। ওর মামাতো ভাই। দুনিয়ার কোনো কাজে তাঁর মন বসে না। সে কবিতা ছাড়া আর কোনো দিকে মন দেয় না।
এই কবিই পারুলের হৃদয়কে হরণ করেছিল একদিন! সেও যদি একটু বুঝতো! আজ হয়তো পারুলকে এভাবে রিক্তহাতে ফিরে আসতে হতো না।
একটু যদি পারুলের দিকে তাকানোর তাঁর সময় হতো! কবিতার সাদা খেরো খাতাকে কিছু সময় বন্ধ রেখে যদি সে পারুলের চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করতো... কিংবা কোনো এক ঘোর বরষায় এই ক্লাবঘরে এক যুবতীর নিজেকে বিলিয়ে দেবার প্রচ্ছন্ন সম্মতির ভাষাটুকুও যদি সে দেখতে পেত সেই চোখে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেটাকে লুকানোর কোনো চেষ্টাই করল না এবারে পারুল। চোখ ঝাপসা হয়ে সামনের সবকিছুকে ঢেকে দিয়েছে। পুরনো স্মৃতি মেঘ হয়ে এই বুঝি বৃষ্টি হয়ে নেমে এলো!একজন কবি ওর মনের গহীনে এখনো এতোটা আবেগ নিয়ে বাস করছে! কই, আগে তো এভাবে অনুভব করেনি? এটা কি একজনের চলে যাওয়াতে সৃষ্ট শুন্যতাকে প্রকৃতির নিয়মে আপনাতেই ভরাট করার এক অটো প্রোসেস?
ভাবালুলতায় বিহ্বল পারুল ঘাটে ওর জন্য অপেক্ষারত মানুষদের দিকে নৌকার ছইয়ের ভিতর দিয়ে তাকায়। কিন্তু কাউকে চিনতে পারে না। যে মানুষটিকে গত পাঁচ বছরে দেহ-মন সব দিয়েছিল, সেই তাকেই চিনতে পারলনা! নিজের ভিতরে কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণের প্রথম ভালোবাসা যা এতোদিনে ফিকে হয়ে এসেছে ভেবেছে, আজ প্রচন্ড উদ্দামতায় তাঁকে নিজের হৃদয়ে অনুভব করে এটা উপলব্ধিতে এলো যে, সে আসলে মানুষ চেনার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে।
নিজেকে চেনাটা যে বড্ডো কঠিন!
শিকদার বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়তেই পারুল এই নির্মম সত্যটিকেও আজ জেনে গেল।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১১৭০ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সাথে থাকার জন্য এবং অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
দেখা যাক, আপনার আগ্রহকে লেখার দ্বারা কত দূর ধরে রাখতে পারি।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
সময় দেবার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
ভালো থাকবেন।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
অনেক ধন্যবাদ অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
আপনি লিখেছেন,
রাস্তা থেকে একটা পরিচিত গলার চীৎকারে পারুলের ধ্যান ভাঙ্গে।ওর ছোট ভাই শিপন বাজার থেকে ফেরার সময় কীভাবে ওকে নৌকায় দেখে ফেলে। ' আপায়! আপায় আইছে' বলে চীৎকার করে বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে।
'শিপন' নামটি আধুনিক, কাহিনীটি পুরানা। আমার আহবান নামটি বদলিয়ে অন্য একটি গ্রাম্য নাম দিন। ধন্যবাদ।
আপনার মন্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে হচ্ছে, না ভাই, কাহিনীটি পুরানা নয়। সামনের পর্বগুলোতে গেলেই আপনি বুঝতে পারবেন। পটভূমি যদিও গ্রামের। কিন্তু সেই গ্রাম এই একবিংশ শতাব্দীরই। তবে সেখানে উন্নয়নের জোয়ার তাকে শহুরে না বানালেও একেবারে যে কিছুটা ছোঁয়া লাগে নাই তাও নয়।
ঠিক আছে, নামটি পরিবর্তন করে মাহমুদ দিলাম। আমার পরিচিত একজন এই নামে গ্রামে রয়েছে, ওর কথাই মনে হল।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
খুশী হলাম.. জাজাকাল্লাহু খাইরান।
ইনশা আল্লাহ চেষ্টা করব।
সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
ভালো লাগল আপনার অনুভূতি জেনে।
সাথে থাকার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
ভালো লাগল আপনার অনুভূতি জেনে।
সাথে থাকার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
আপনি জমিয়ে পড়তে ভালোবাসেন, জেনে খুশী হলাম। সবগুলো পর্ব এক সাথে পড়তে পারবেন সময় নিয়ে।
আর ব্লগে নতুন তো, তাই অনেক কিছু এখনো বুঝতে পারছি না। তবে 'প্রিয়দের লেখা পড়ার আমন্ত্রণ' অপশনটি দেখে কয়েকবার ক্লিক করেছিলাম। পরে চিন্তা করলাম এবং নিজের কাছেও একটু লজ্জা লাগল যে, লেখা পোষ্ট করে ধরে ধরে সবাইকে পড়ার জন্য আমন্ত্রণ করব! সেই লজ্জা থেকে আর ওখানে ক্লিক করি নাই।
ধন্যবাদ আপনাকে অনুভূতি রেখে যাবার জন্য। এই লেখাটি শেষ না করা পর্যন্ত নতুন কিছুতে হাত ও দিতে পারছি না।
ভালো থাকবেন।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন